সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৩ অপরাহ্ন
বরগুনা প্রতিনিধি॥ বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্যে জীবনের আরেকটি বড় অধ্যায় কষ্ট। যে কষ্ট একদিন জীবনের সকল দুঃখ-কষ্ট আর গ্লানি মুছে দিয়ে সুখের দেখা মিলাতে পারে। সেরকমই একজন মানুষের গল্প শোনাব। যে গল্প হতে পারে স্বপ্নবাজ তরুণদের অনুপ্রেরণা। যার মধ্যে আছে মনুষ্যত্ববোধ। আছে ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মন জয় করার এক আশ্চর্যময় ক্ষমতা। বরগুনা জেলাধীন পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া ইউনিয়নে বসবাস করত মোনাসেফ মুসুল্লি। ৭০ এর নির্বাচনে নৌকা প্রতিককে জয়ের মালা গলায় পরানোর পরে স্থানীয় তোপের মুখে চলে যেতে হয়েছিলো পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলাধীন কুয়াকাটার খাজুরা গ্রামে।
পাকিস্তানিদের ভয়ে যখন ঘর থেকে বাহিরে নামায় ছিলো নিষেধাজ্ঞা। ঠিক তখনই ভয় আর আতঙ্ক বিরাজ করত সবার মাঝে। তখন ভয়ে ভয়ে রুজিরোজগার করতে হত সবার মতো দরিদ্র কৃষাণীদেরও। তবুও পেটের তারনায় না নেমে উপায় কি! একদিন মাঠে কাজ করতে গিয়ে ধান বীজের পাতা ঢুকে যায় মোনাসেফের চোখের মধ্যে। চিকিৎসার জন্য যেতে হয়ে ছিলো বরিশালে। এরমধ্যেই বাঙ্গালির জীবনের মুক্তিযুদ্ধ নামক সবথেকে বড় একটি অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
যেখানে দীর্ঘ নয়টি মাস যুদ্ধ চলে। শেষমেস দরিদ্রতার কাছে চোখের চিকিৎসা হার মানে। সে যে চিকিৎসার জন্য বরিশালে কি অবস্থায় রয়েছে, এমন খবর দিতেও হিমসিম খেতে হয়েছিলো পুরো নয়টি মাস জুড়ে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙ্গালি যখন দেশ জয়ের স্লোগান আর লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে জানান দিচ্ছিলো আমরা বিজয়ী বীর বাঙ্গালি। ঠিক তখন একটি চোখের দৃষ্টি হারিয়েই বাড়িতে ফিরতে হয় মোনাসেফকে। দরিদ্র আর হতভাগা সেই মানুষটির আট সন্তানের মধ্যে শহীদ তৃতীয় নম্বরে। দরিদ্র বাবা মোনাসেফ মুসুল্লি ও সরলতার মায়ায় জড়ানো ফজিলাতুন্নেসা এর গর্বে ৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩ সালে কুয়াকাটা খাজুরা গ্রামে জন্ম হয় এই শহীদুল ইসলামের। ভাই-বোনের মধ্যে সবার থেকে বড় রেহানা আক্তারের কপালে শিক্ষার ছোঁয়া বেশিদুর না লাগলেও মেজ হাবিবুল্লা কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিকাহ্ বিষয়ে পি.এইচ.ডি অর্জণ করে। তিনি বাউফলের কালিশুরি ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন। এরপরেই শহীদ। যার কীর্তি একটু আলাদা করে না বললেই নয়। চতুর্থ নম্বরে মোহিব্বুল্লাহ সরকারি বিএম কলেজ থেকে স্নাতোকোত্তর শেষ করে সৌদি আরবে প্রবাসী জীবন কাটাচ্ছেন।
পঞ্চমে রয়েছেন মোঃ ওলিউল্লাহ। তিনিও স্নাতোকোত্তর সম্পন্ন করে বরিশালের বাকেরগঞ্জে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহাকরি শিক্ষক পদে কর্মরত। ষষ্ঠ মোঃ মাহবুবুর রহমান। সেও স্নাতোকোত্তর সম্পন্ন করে কুয়াকাটা ইসলামপুর দাখিল মাদ্রাসায় অফিস সহাকারি পদে কর্মরত। সপ্তমে ইসরাত জাহান। সবার মতো তিনিও শিক্ষা জীবনে স্নাতোকোত্তর লাভ করে স্বামীর সাথে ঢাকায় সংসার জীবন কাটাচ্ছেন। অষ্টম ও শেষ স্থানে মোঃ সাইফুল্লাহ্। তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করে বরিশাল বিএম কলেজে মাস্টার্সে অধ্যায়নরত রয়েছেন। তবে আট ভাই-বোনের মধ্যে শহীদের মধ্যে ছিলো তীব্র আশার প্রদীপের স্প্রিহা। ইচ্ছে ছিলো ভালো মানুষ হয়ে দেশের ভালো কাজে অংশ নিয়ে গর্বিত ও প্রথম শ্রেণির নাগরিক হবার। বাবার দারিদ্রতাকে পাশে রেখেই শহীদকে পথ চলতে হয়েছে অনেকটা। শহিদ শিক্ষা জীবনে তৎকালীন কুয়াকাটা এলাকার একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুয়াকাটা ইসলামপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৯১ সালে দারিদ্রতার কষাঘাতে ৫ম শ্রেণিতে বৃত্তি পরিক্ষা না দিতে পারা ছেলেটি ১৯৯৭ সালে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দাখিল (এস.এস.সি) তে মাদ্রাসা বোর্ডে সেরা বিশ তালিকার মধ্যে স্থান করে নেয়। রেজাল্টের পরপরই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁকে ভর্তি করানোর জন্য আগ্রহ দেখালেও তিনি বরগুনা খাকবুনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৯৯ সালে আলিম (এইচ.এস.সি) তেও মাদ্রাসা বোর্ডে সেরাদের মধ্যে বারতম স্থান দখল করেন। বোর্ড থেকে প্রকাশিত সেরাদের মধ্যে সেরা অর্জণকারী শহীদ ২০০১ সালে ঝালকাঠী এন.এস কামিল মাদ্রাসা থেকে স্টার মার্কস্ নিয়ে ফাজিল (ডিগ্রী) অর্জণ করেন। পাশাপাশি ২০০২ সালে পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক (বিএ) পাস করেন। সেখানেও তিনি প্রথম বিভাগ অর্জণ করেন। এরপরে ২০০৪ সালে সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতোকোত্তর (এম.এ) পাস করেন। ২০০৫ সালে তিনি বাংলাদেশের মধ্যে ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বি.এড) পরিক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অর্জণ করে সর্বমহলে সাড়া ফেলে দেন। তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় ফলোআপ রিপোর্ট হয়। শিক্ষা জীবন শেষ করে বস।
স্বপ্নের সোপান ছোঁয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে শক্ত ভিত তৈরি করার লক্ষে এগিয়ে চলেন দুর্বার গতিতে। বিভিন্ন চাকুরির পরিক্ষায় নিমিষেই পাস করতেন তিনি। কিন্তু ব্যাংকার হওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে সহকারি কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরি হয় তাঁর। ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে কয়েক ধাপ পদোন্নতি হয় শহিদুলের। তবুও যেনো কি একটা কমতি আর অপূর্ণতায় ঘীরে থাকত শহীদুলকে। ব্যাংকার থাকা অবস্থায়ই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে ২৮ ও ২৯ তম বিসিএস এ প্রিলিমিনারি থেকে লিখিত পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইবার সিড়ি পাড় হতে ব্যার্থ হলেও মনের মধ্যে বিরাজমান স্বপ্ন আর প্রবল ইচ্ছেশক্তি তাঁকে সফলতার চূড়ায় যেতে হাতছানি দিচ্ছিল।
কোন ধরণের কোচিং কিংবা অতিরিক্ত পরামর্শ ছাড়াই ত্রিশ বছর বয়সে ত্রিশ তম বিসিএস এ উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম চয়েজ শিক্ষা ক্যাডার পেয়ে বর্তমানে বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজে প্রভাষক পদে কর্মরত রয়েছেন। শহিদুল ইসলাম একজন আদর্শবান শিক্ষক বলেই তাঁর একান্ত পরামর্শে সফল ক্যারিয়ার গড়তে সক্ষম হয়েছে শতাধীক শিক্ষার্থী। তিনি ফ্রি অতিরিক্ত পাঠদান করিয়ে সফলতা এনেছেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আজ তিনি শুধুমাত্র একজন শিক্ষকই নন বরং নিজের গুণ দিয়ে শিক্ষার্থী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে একটা মেলবন্ধন তৈরি করে রেখেছেন সকলের গহ্বরে। শহিদুল ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর নিজ উপজেলায় নাসির উদ্দীনের দ্বিতীয় নম্বর মেয়ে সাদিয়া আক্তারের সাথে বিবহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
বর্তমানে ৭ বছর বয়সী একটি ছেলে সন্তানের জনক। শহিদুলের স্ত্রী সাদিয়া কলাপাড়া আলিয়া মাদ্রাসায় সদ্য সহকারি শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন।
Leave a Reply